Pages

মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১৬

জাসদ এবং জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিপ্লবীরা!

সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞ্যা এবং মুষ্টিবদ্ধ স্লোগান দিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ‘জাসদ’- এর জন্ম নেয় ১৯৭২ এর ৩১ অক্টোবরে।

তবে তার আগেই, ১৯৭২ এর প্রথম দিকেই, ছাত্রলীগকে ভেঙ্গে রব –সিরাজ ভাই যুদ্ধ বিধ্যস্ত শিশু রাষ্ট্র, বাংলাদেশকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তার পরে জন্ম নেয় জাসদের!
তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হছে – জাসদ তার চটকদার স্লোগান ও বক্তব্যে দিয়ে আকৃষ্ট করেছিল কিছু মেধাবী তরুণদের, যাদের মধ্যে জেগে উঠেছিলো সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন!
বেদনাদায়কভাবে, তাদের সেই স্বপ্ন নষ্ট হয়, দুঃস্বপ্ন হয়ে এবং খুব অচিরেই।
ওই স্বাপ্নিক বিভ্রান্ত তরুণরা বুঝতে পারেননি, তাদের বা জাসদের নেতারা ছদ্মসমাজতান্ত্রিক! যাদের কাজ মাৎসান্যায় সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার বা অর্জন করা। আর জাসদ দলের প্লাটফর্মের সুযোগ নিয়েছিলো স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা!
জামাত-রাজাকার-আলবদর-­শিবির-নেজামী ইসলাম–মুসলিম লীগ-পিডিপি-চীনা বাম পন্থী নেতাকর্মী– সমর্থকদের-সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ ও শক্তি শালী রাজনৈতিক ‘প্লাটটফর্ম ছিল জাসদ!
তারা এতে পেয়েছিলো আশ্রয়, দেখা দিয়েছিলো বিপ্লবী রূপে।
কিন্তু জাসদের প্রতিষ্ঠাতা ও বড় বড় প্রায় সব নেতারা (২/১ জন ব্যতিক্রম ছাড়া) সবাই ছিলো লোভী, দুষ্ট, নীতিহীন!
আমরা বুঝতে পারছিলাম, ক্ষমতা দখল করাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য! বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নয়! নেতাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে জাসদের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা দেশকে ধ্বংস করতে থাকে।
পরে জাসদের এই নেতারা প্রমাণ করেছে, তারা কতো, নীতি হীন, দুষিত, প্রতিক্রিয়াশীল ও নষ্ট ছিলো।
(১) জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মেজর জলিল হয়ে উঠেছিলো মূর্তিমান কার্ল মার্ক্স-চুলে দাড়িতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রতিরূপ! কিন্তু কিছু দিন পরেই তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন ইসলামি মৌলবাদে, খেলাফত আন্দোলনে। মারা যায় পাকিস্থানে!
মেজর (অব:) এম এ জলিল —
• ১৯৭২ সালে বৈজ্ঞ্যানিক সমজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে গড়া দল জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়ে
• ১৯৭৩ সালে সমজতন্ত্রের ‘আফিম’ খেয়ে “শূয়রের খোঁয়াড়” এর বাসিন্দা হওয়ার তুমুল চেষ্টা করে,
• ১৯৭৬ সালে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেল জুলুম খেটে,
• ১৯৮১ সালে বুর্জুয়া রাষ্ট্রের প্রধান, রাষ্ট্রপতি হওয়ার নির্বাচন করে,
• ১৯৮৬-৮৭ সালে সেই জাসদ ছেড়ে সেই “হিপ্পি” মেজর জলিল ইসলামী আন্দোলনে যোগদান করে ইসলামী বিপ্লবের দিকে ধাবিত হলেন!
১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জাসদ অংশ নিয়ে জাসদ সভাপতি মেজর জলিল মাত্র প্রায় আড়াই লাখ ভোট পেয়ে ৫ম হয়েছিল ছিল।
আর আওয়ামী লীগের একজন জনবিছিন্ন বিতর্কিত এবং অজনপ্রিয় প্রার্থী, ডঃ কামাল জাসদের চেয়ে প্রায় ২৪ (চব্বিশ) গুন ভোট পেয়ে, অর্থাৎ ৬০ লাখ ভোট পেয়ে ২য় হয়েছিল!
মেজর জলিল নিজের সম্বন্ধে নিজেই লিখেছেন–
• লোভ, মোহ আমাকে আদর্শচ্যূত করতে পারে না বলেই আমার পথ সর্বদা কণ্টকাকীর্ণ এবং দুর্গম থেকে যায়।
• আমি একজন তৌহীদবাদী সৈনিক।
• জাসদের সভাপতি থাকাকালীন অবস্থায়ও আমি কখনো মার্ক্সবাদে এবং নাস্তিকবাদে বিশ্বাস করতাম না!
• তাই কমিউনিস্ট আমি কখনো ছিলাম না।
(যদিও নাস্তিক না হয়ে একজন কমিউনিস্ট হওয়া যায় না — এ সত্যটি মার্কসবাদেই স্পষ্টভাবে বর্ণিত)
আবার মেজর জলিল নিজেই নিজের স্ববিরধিতা করে লিখেছেন,
• “১৯৭৪-৭৫ সনে কারাগারে বসেই উনি মার্কসবাদ সম্পর্কে আরও অধিক জ্ঞান অর্জনে ব্রতী হন এবং তার মার্কসবাদ জ্ঞান চর্চার একমাত্র লক্ষ্যই ছিল নির্যাতিত মানুষের সত্যিকারের মুক্তির পথ অনুসরণ করা।”
• (১৯৭৪-৭৫ সনে কারাগারে বসেই “মার্কসবাদ মুক্তির পথ” নামে একটি বই লিখেন এবং তা প্রকাশ করেন!)
“তাই আমার জাসদ ছেড়ে ‘ইসলামী বিপ্লবে’র পথে আসার ঘটনাটিকে যারা আকস্মিক ঘটনা, কিংবা কোন সুবিধাবাদী পদক্ষেপ বলে মনে করেন, তাদের সে ধারণা মোটেও সঠিক নয়।” – মেজর জলিল!
এই হচ্ছে আমাদের দেশের প্রধান এবং সবচেয়ে জনসমর্থন ওয়ালা সমাজতন্ত্রী বাম পার্টি, জাসদের নেতাদের আত্ম পক্ষ সমর্থন এবং শ্রেণী বিচ্যুতির পক্ষে স্ববিরোধী সাফাই!
(২) জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, আ স ম রব ভাই, নীতিচ্যুত হয়ে, চরিত্র হারিয়ে, দুর্নিতী করতে – এমন কোন কাজ (গৃহ পালিত বিরোধী দলের নেতা, শেখ হাসিনার মন্ত্রী সহ) বাকী কিছুই রাখেন নাই! কোটি টাকা খরচ করে, তার দুই ছেলেকে আমেরিকাতে পড়াশুনা করতে পাঠায়, এই মার্কস বাদী সর্বহারা নেতা!
জাসদ সৃষ্টির আগেই পল্টন ময়দানে, সেই অনাবশ্যক সৃষ্টি ‘জাসদ’ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সাধারণ সম্পাদক, বিভ্রান্ত, নীতিহীন, লোভী সেই আ স ম রব ১৯৭২-৭৩ এ যেসব বক্তৃতা করেছিলেন, সেগুলোর অংশ বিশেষ দেখুন।
‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রত্যাহার করে সেই নীতিহীন, লোভী রব বঙ্গবন্ধকে উদ্দেশ করে বলছেন,
(ক) ‘শেখ মুজিব, বাচ্চা দিয়েছিস, দুধ দিবি না? তোর বাণ টেনে ছিঁঁড়ে দুধ বের করব।’
(খ) ‘শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে আমরা জুতা বানব।’
সেই জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি আ স ম আবদুর রব ১৯৯৬ তে আওয়ামী সরকারের সময় মন্ত্রী হয়ে–
“বঙ্গবন্ধ” এবং “জাতির পিতা” বলে বলে মুখে ফেনা তুলেছেন! শুধুই বঙ্গবন্ধর স্তুতিবাক্যে বলেছেন, কারনে অকারনে!
সেই আমলে “মাল কড়ি” ভালই কামিয়েছিলেন! পরে দুই ছেলেকে আমেরিকাতে পড়িয়েছেনও কোটি কোটি টাকা খরচ করে। তখনকার (৯৬-০১) তার এপিএস ডাক্তার জীবন এখন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা এবং বিএনপির হয়ে হবিগঞ্জে নির্বাচনও করে!
আ স ম রব ভাইয়ের এর সম্পর্কে ইনু ভাইয়ের কিছু কথামালার, একটু ‘কোট’ করছি–
ইনু ভাই, নব্বই দশকে, এক সাক্ষাৎকারে তাঁর প্রাক্তন সহযোদ্ধা আ স ম রবকে অভিহিত করেন,
“রাজনৈতিক অঙ্গনের জঞ্জাল” রূপে।
তবে, বিস্ময়ের ব্যপার, এই (জাসদ-রব) জঞ্জালের সঙ্গেই, কিছু দিন পর ইনু ভাই তার জাসদ ইনু গ্রুপ আবারও ঐক্যবদ্ধ হয় ১৯৯৭ সালে। আরও মজার ব্যপার হচ্ছে, কিছুদিন পর আবার সেই ঐক্য ভেঙ্গেও যায়।
৩) জাসদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, শাজাহান সিরাজ ভাই সম্বন্ধে কি বলব! ২০০৪ সালে ১টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ১ম পৃষ্টার হেডিং ছিল, কোটি কোটি টাকা খরচ করে জামাত-বিএনপি মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের ছেলের বিয়ে দিলেন! মন্ত্রী থাকার পরও ওই সংবাদের কোন প্রতিবাদ করতে পারেন নাই!
(৪) জাসদের দৈনিক পত্রিকা, গণকন্ঠের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন আল মাহমুদের মতো একজন মৌলবাদী! তখন তিনি নাকি ছিলেন বিপ্লবী! যদিও বিরাট ও দামী গাড়ি চড়ে সুখ পেতেন সর্বহারা পার্টি, জাসদের গণকন্ঠ এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আল মাহমুদ। তাকে গাড়িতে এমনভাবে বসা দেখে অনেকে তাকে দেশের রাষ্ট্রপতিও মনে করত। আর এখন সে চিন্তা চেতনায় এবং বেশ ভুসায় এক পাক্কা বড় জামাতি। জামাতী পত্রিকা, “নয়া দিগন্ত” এর উপদেষ্টা ও কলাম লেখক!
(৫) ১৯৭২-৭৪ সালে জাসদের দৈনিক ‘গনকন্ঠ’ বের করা হত জামাত-শিবিরের দলীয় পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামের প্রেস ও অফিস থেকে! এই “জামাত-শিবিরের দৈনিক সংগ্রামের প্রেস ও অফিস” দখলের জন্য জামাত-শিবির কখনও জাসদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোন অভিযোগ আনে নাই! করন টি সুস্পষ্ট! কারন জাসদের ওই দৈনিক ‘গনকন্ঠ’ ওই সত্য-মিথ্যা খবর ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলত! যে সমস্থ মিথ্যা, ভুয়া, সত্য-মিথ্যা খবরকে এখনও অনেক বাম এমনকি জামাত-বিএনপি ‘রেফারেন্স’ হিসাবে ব্যবহার করে!
জাসদের এমন আরো অনেক স্ববিরোধী, বিতর্কিত কাজকর্ম এবং ইতিহাস, “বৈজ্ঞ্যানিক সমজতন্ত্র” প্রত্যয় ও প্রতিষ্ঠার সপথ নেয়া এদের বড় বড় কমরেড ও বিপ্লবীর চরিত্র, অতীত- বর্তমান ইতিহাস আমারা জানি!
আজ দেখুন,
সাবেক জাসদের সেই বড় বড় (!) ও প্রতিষ্ঠাতা কমরেড ও বিপ্লবী নেতাদের অবস্থান কোথায়?
• কেউ বৈজ্ঞ্যানিক সমজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শপথ ছেড়ে ইসলামী আন্দলনের বীর সৈনিক!
• অনেকে পাকি-জামাত সহযোগী বিএনপির বড় নেতা, মন্ত্রী!
• কেউ ‘গণবাহিনী’ এবং এর রাজনীতি ছেড়ে এখন তবলীগের আমীর!
• কেউ মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠার শপথ ত্যাগ করে খেলাফত আন্দলনের বড় নেতা!
• কেউ বা ‘হালুয়া রুটি’র লোভে এরশাদের গৃহ পালিত নেতা!
• কেউ বা আওয়ামী লীগের বড় নেতা, মন্ত্রী!
সাবেক জাসদের বড় বড় (!)কমরেড ও বিপ্লবী নেতাদের,
জীবন-যাত্রা, গাড়ী, বাড়ী-ঘর, বিদেশে তাদের সন্তানদের ব্যয় বহুল লেখাপড়া, জাকজমকের বিয়ে সাদী, ইত্যাদি প্রমান করে যে তাদের ৯৫%ই চরম দুর্নীতিগ্রস্ত বা লোভী বা নীতি হীন!
এই ছিলো জাসদের “বৈজ্ঞ্যানিক সমজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শপথ” বিপ্লবীরা এবং জাসদের সামাজিক বিপ্লব!
এই গুলি আরও প্রমান করে,
জাসদের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের­ মাত্র ৫% তাঁদের (জাসদের) মূল রাজনৈতিক দর্শনের, “বৈজ্ঞ্যানিক সমাজতন্ত্র” কে বিশ্বাস করত!
বাকী,
৯৫%ই ছিল জামাত-রাজাকার-আলবদর-­শিবির-নেজামী ইসলাম–মুসলিম লীগ-পিডিপি-চীনা বাম পন্থী নেতা-কর্মী–সমর্থক!
জাসদ ছিল (অন্তত ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত) তাদের ‘নিরাপদ’ ও শক্তিশালী আশ্রয় স্থান!
তারা ১৯৭২ সালের পর –
• ১৯৭১ এ তাঁদের সাধের পাকিস্থান ভাঙ্গার জন্য,
• বঙ্গবন্ধুকে ও আওয়ামী লীগকে গালি দেওয়ার জন্য,
জামাত-রাজাকার-আলবদর-­শিবির-নেজামী ইসলাম–মুসলিম লীগ-পিডিপি-চীনা বাম পন্থী নেতাকর্মী – সমর্থকদের-
সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ ও শক্তি শালী রাজনৈতিক ‘প্লাটটফর্ম ছিল জাসদ!
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে,
বেশীর ভাগ মুসলিম লীগ-পিডিপি-রাজাকার-ন­েজামী ইসলাম–-চীনা বাম পন্থী নেতাকর্মী–সমর্থকরা – তাদের আদি (আদর্শের ও পছন্দের) দলে ফিরে যায়!
যখন
• পাকি সমর্থকদের নতুন দল, বিএনপি গঠন করে,
• জামাত যখন তাদের আসল দলকে সংঘটিত করা শুরু করে –
তখন, ১৯৭৭-৭৯ সাল থেকে, জাসদে ভাঙ্গনের খেলা শুরু হয়!
জাসদ (তাও কয়েক ভাগ হয়), বাসদ (তাও কয়েক ভাগ হয়), জে এস ডি!
জাসদ এখন পরগাছা বা কাগুজে দলে পরিনিত হয়েছে!
এক কথায়,
জাসদের সৃষ্টি-বিকাশ এবং অতীত ইতিহাস –
বড় রহস্যময়, করুন, বেদনাদায়ক এবং নিষ্ঠুরও বটে!
  • 0Blogger Comment
  • Facebook Comment

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন